Sunday, February 3, 2013

আবারও ব্যবসা শুরু করেছে ডেসটিনি


তারিখ: ০৪-০২-২০১৩     
আট মাস বন্ধ থাকার পর আবারও বহু স্তর বিপণন (এমএলএম) পদ্ধতির ব্যবসা শুরু করেছে ডেসটিনি। কারাগারে বসে ব্যবসার কৌশল ঠিক করে দিচ্ছেন ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল আমীন।
বিতর্কিত এমএলএম-পদ্ধতিতেই আপাতত শুরু হয়েছে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের কার্যক্রম। পরে শুরু করা হবে ডেসটিনি ট্রি-প্ল্যানটেশন এবং ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কর্মকাণ্ড।
ডেসটিনি সূত্রে জানা গেছে, এ দফায় এমএলএম-পদ্ধতির ব্যবসা-কৌশল বাস্তবায়ন করছেন রফিকুল আমীনের ভাইয়ের ছেলে আশরাফুল আমীন। তিনি ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। যোগাযোগ করলে নতুন করে ব্যবসা শুরুর কথা জানিয়ে আশরাফুল আমীন বলেন, ‘আইনগতভাবে ব্যবসা করতে আমাদের বাধা নেই। তাই নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছি।’
ডেসটিনি নতুন করে যেসব পণ্য বিপণন করছে, তার মধ্যে রয়েছে আমদানি করা নিম্নমানের নাইজেলাসহ উত্তেজক ট্যাবলেট, টেলিভিশন, ফুট ম্যাসেজার (পা ম্যাসাজকারী যন্ত্র) ইত্যাদি। আমদানি করা এসব পণ্য ডেসটিনি ব্র্যান্ড নিয়ে এত দিন বাজারে ছিল।
কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে এই কোম্পানি কোনো পণ্য উৎপাদন করে না। ডেসটিনির ওপর করা যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয়ের (রেজসকো) চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পণ্য উৎপাদন না করেও নিজেদের উৎপাদক হিসেবে জাহির করছে ডেসটিনি, যা স্রেফ প্রতারণার শামিল।
রেজসকো থেকে নিবন্ধন নেওয়ার সময় ডেসটিনি ২০০০সহ ডেসটিনি গ্রুপের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই সংঘস্মারকে এক লাইনে এমএলএম-পদ্ধতিতে ব্যবসা করতে পারার কথা উল্লেখ রয়েছে। রফিকুল আমীন কারাগারে যাওয়ার আগে ওই এক লাইনকেই আইনি ভিত্তি বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছিলেন। একই দাবি করেন আশরাফুল আমীন। তিনিও বলেন, ডেসটিনি ২০০০-এর এমএলএম-পদ্ধতির ব্যবসা বেআইনি নয়।
কিন্তু উভয়ের দাবিকেই উড়িয়ে দিয়ে রেজসকো নিবন্ধক বিজনকুমার বৈশ্য প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধন নেওয়া মানেই সব নয়। রেজসকো থেকে নিবন্ধন নিলেও ব্যবসা করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট অন্য নিয়ন্ত্রক থেকে অনাপত্তিপত্র নিতে হয়। যেমন-ব্যাংক, বিমা কোম্পানিগুলো তা নিয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, এমএলএম-পদ্ধতির ব্যবসায়ের কোনো নিয়ন্ত্রক না থাকার ফাঁকটিই ব্যবহার করেছে ডেসটিনি। তবে আইনের ফাঁক ব্যবহার করে প্রতারণা করলেও প্রতারণা প্রতারণাই এবং এর জন্য প্রচলিত আইনে শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। এরই মধ্যে এমএলএম আইন তৈরির কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পর এমএলএম আইনের একটি খসড়া বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) অপেক্ষায় রয়েছে।
কিন্তু আইন পাসের অপেক্ষা করছে না ডেসটিনি। কারণ, খসড়ায় এমন সব ধারা উল্লেখ রয়েছে যে এই আইন পাস হলে ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান আর এমএলএম-পদ্ধতির ব্যবসা করতে পারবে না।
সূত্রগুলো বলছে, ডেসটিনির মধ্যম পর্যায়ের ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিদিন কারাগারের দর্শনার্থী কক্ষে গিয়ে রফিকুল আমীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই হলেন ডেসটিনির ‘প্রফিট শেয়ারিং ডিস্ট্রিবিউটর’ বা পিএসডি। রফিকুল আমীন একজনকে খবর দিয়ে পরের দিন আরেকজনকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলছেন। নতুন উদ্যমে ডেসটিনির ব্যবসা শুরুর নির্দেশনা দেন তিনি ওখান থেকেই। গ্রুপের এমডি কারাগারে থাকায় অনেকেই সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন—এ কথা উল্লেখ করে আশরাফুল আমীন বলেন, ‘ব্যবসায়ের বুদ্ধি-পরামর্শ তো তিনি দিতেই পারেন।’ ডেসটিনির ২২ শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা অর্থ পাচারের দুই পৃথক মামলায় রফিকুল আমীনের পাশাপাশি ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন ও পরিচালক কর্নেল (অব.) দিদারুল আলমও এখন কারাগারে। গ্রুপের প্রেসিডেন্ট লে. জে. (অব.) হারুন-অর-রশিদ শর্ত সাপেক্ষে জামিনে রয়েছেন। বাকি ১৮ আসামি সাড়ে তিন মাস ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও বাকি আসামিদের ধরার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়েও বলা আছে।’
জানা গেছে, কয়েক মাস ধরেই ডেসটিনিকে চাঙা করার দায়িত্ব পালন করছেন আশরাফুল আমীন। এর মধ্যে পিএসডিদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। দুই সপ্তাহ আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন আশরাফুল আমীন।
এদিকে, গৃহবিবাদও শুরু হয়েছে ডেসটিনিতে। আশরাফুল আমীনের নেতৃত্ব মানতে চাচ্ছেন না কেউ কেউ। সূত্রগুলো বলেছে, ডেসটিনির শীর্ষ ব্যক্তি প্রত্যেকেরই নিজস্ব পিএসডি রয়েছেন। আশরাফুল আমীনের ডাকা বৈঠকগুলোতে পরিচালক মেজবাহউদ্দিন স্বপন ও সাঈদ-উর-রহমানের লোকেরা যোগ দিলেও পুরোপুরিই এড়িয়ে থাকছেন ডেসটিনি গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ গোফরানুল হকের লোকেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে পাঁচ হাজার কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে ডেসটিনি সংগ্রহ করলেও বর্তমানে এ টাকার কোনো হদিস নেই। বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্তিতে রয়েছেন আদৌ তাঁরা মূল টাকাই ফেরত পান কি না। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে দেখেছে, এর মধ্যে বিপুল অঙ্কের টাকা হংকং, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ইত্যাদি দেশে পাচার হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ডেসটিনির ডিএমডি মোহাম্মদ গোফরানুল হকের মালিকানাধীন আপেলবাগান রয়েছে বলে জানেন ডেসটিনির কর্মকর্তারা।
এদিকে, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ কার্যক্রম সম্পর্কে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ডেসটিনির এমএলএম ব্যবসা বন্ধ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, কোম্পানি আইন, সমবায় সমিতি আইন, আয়কর অধ্যাদেশ ও দণ্ডবিধি অনুযায়ী ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে পাচার হতে না পারে, সে জন্য অবিলম্বে ডেসটিনির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই কার্যকর হচ্ছে না।
কে কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে—তা দেখভাল করছে এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ছাড়া অন্য কোনো আইনে এখন পর্যন্ত ডেসটিনির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় গত ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বাণিজ্যসচিব মাহবুব আহমেদ। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের লিখিত বক্তব্য দিতে বলা হয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গতকাল রোববার পর্যন্ত রেজসকো ছাড়া কেউই কিছু জানায়নি।
সমবায় অধিদপ্তরের অতিরিক্ত নিবন্ধক অমিয়কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগে একটি তদন্ত করেছিলাম। এবার করছি নিবিড় তদন্ত, যা শেষের পথে। এটি হয়ে গেলেই দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে।’
যোগাযোগ করলে বাণিজ্যসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ে জবাব পাইনি। তাগাদাপত্র দেওয়া হয়েছে। সেটারও কোনো জবাব পাইনি। সবাইকে আমরা আবারও তাগাদাপত্র দেব।’ বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি বলেন, দুদক ছাড়া সরকারের অন্য কোনো সংস্থা ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। বিষয়টি তাঁর কাছে রহস্যজনক বলে মনে হয়

No comments:

Post a Comment

visite